শক্রবার ০২ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
জাতীয়

‘বাবা, আমি মারা যাচ্ছি, আমার লাশটা নিয়ে যেও’

নিজস্ব প্রতিবেদন ১০ নভেম্বার ২০২৪ ০৯:৩৫ পি.এম

‘বাবা, আমি মারা যাচ্ছি, আমার লাশটা নিয়ে যেও’ ছবি: সংগৃহীত

অভাব-অনটনের সংসার। তাই নাফিসা চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষে প্রবাসী মায়ের সাথে সংসারের হাল ধরতে। কিন্তু তার এ ইচ্ছে আর পূরণ হলো না। বুলেটের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল তার স্বপ্নের আকাশ।

বলছিলাম সাভারের একমাত্র নারী শহীদ ও শিক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়ারের কথা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের পাকিজার সামনে ঘাতকের একটি বুলেট নিস্তব্ধ করে দেয় রাজপথের অগ্রসৈনিক নাফিসাকে। বুলেট বুকের একপাশ ভেদ করে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে দুঃসাহসী নাফিসা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল গাজীপুরের টঙ্গীর দত্তপাড়ার সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল এন্ড কলেজের এইসএসসির পরীক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭)। পিতা চা দোকানি আবুল হোসেন এবং মা কুয়েত প্রবাসী কুলসুম বেগম। গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদনগরে। প্রথমে সাভারের মামার বাড়িতে থেকে সাভার ল্যাবরেটরি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে এইসএসসি পর্যন্ত পড়লেও পরবর্তীতে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বাবার কাছে গাজীপুরে এসে ভর্তি হন সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল এন্ড কলেজে। মা কুলসুম বেগম ভাগ্য ফেরাতে চা দোকানী স্বামীকে রেখে কুয়েতে যাওয়ার পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। একপর্যায়ে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নাফিসা হোসেন মারওয়া ছাড়াও সাফা হোসেন রাইসা (১২) নামের আরও একটি মেয়ে রয়েছে আবুল হোসেন-কুলসুম দম্পত্তির।

নাফিসা সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল এন্ড কলেজ থেকেই অংশ নেন ২০২৪ সালের এইসএসসি পরীক্ষায়। ফলও বের হয়। উত্তীর্ণ হন জিপিএ ৪.২৫ পেয়ে। কিন্তু রেজাল্ট দেখার সৌভাগ্য হয়নি নাফিসার। তার আগেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদ হন তিনি। সেই সাথে ধুলিসাৎ হয়ে যায় খুঁড়িয়ে চলা একটি পরিবারের স্বপ্ন।

শহীদ নাফিসার বাবা আবুল হোসেন বলেন, আমার মেয়ে নাফিসা ছিল অত্যন্ত সাহসী। পড়াশোনায়ও ছিল ভালো। আমার সায় না থাকলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই নাফিসা ছিল সোচ্চার। প্রতিটি আন্দোলনে অন্যান্য শিক্ষার্থীর সাথে ও রাজপথে থাকতো। আমার বাসা থেকে প্রায় এক সপ্তাহ আগে গত ২৭ জুলাই নাফিসার বড় মামা হানিফ আলীর বাড়ি ঢাকার ধামরাইয়ে যায়। সেখানে তিনদিন বেড়ানো শেষে ৩০ জুলাই চলে যায় ওর ছোট মামা হযরত আলীর বাড়ি সাভারের কোটবাড়ি এলাকায়। সেখানে থেকেই আগের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে যোগ দিত আন্দোলনে।

আবুল হোসেন বলেন, ওর মায়ের সাথে কথা না হলেও আমার মেয়ে নাফিসার সাথে আমার প্রায়ই কথা হতো। ঘটনার দিন গত ৫ আগস্ট দুপুরে হঠাৎ-ই আমার মেয়ে নাফিসা আমাকে বলে, বাবা তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি টিভি দেখ, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা না কি পালাইছে, তখন আমি তাকে বলি মা আমরা গরিব মানুষ, আমি চা দোকানদার, আমাদের এসব দিয়ে কী হবে, তুমি বাড়ি চলে আসো, তখন আমার মেয়ে আমাকে বলে, ‘বাবা দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমি বাড়ি ফিরব না, আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব’। এর কিছুক্ষণ পর দুপুর আড়াইটার দিকে আবার আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘বাবা আমি গুলি খেয়েছি, আমি মনে হয় আর বাচঁব না, আমি মারা যাচ্ছি, আমি ল্যাবজোন হাসপাতালে আছি, আমার লাশটা নিয়ে যেও’। তখন আমি দোকান ফেলে দ্রুত সাভারের উদ্দেশে রওনা দেই। আসতে আসতে পথিমধ্যে আমি আমার মেয়ের মোবাইলে ফোন দেই। তখন আমার মেয়ের মোবাইলটি অন্য কেউ রিসিভ করে আমাকে বলে, আপনি কে বলছেন, তখন উত্তরে আমি নাফিসার বাবা পরিচয় দিলে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আমাকে জানানো হয় আপনার মেয়ে আর নেই, মারা গেছেন, লাশ এখন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে রয়েছে। আসার পথে সড়কের অবস্থা ভালো না থাকায় আমার আসতে খানিকটা দেরি হওয়ায় হাসপাতাল থেকে নাফিসার ছোট মামা হজরত আলী নাফিসার মৃতদেহ নিয়ে আসে। পরে আমাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদনগরে কবরস্থ করা হয় নাফিসাকে।

শহীদ নাফিসা হোসেন মারওয়ার একমাত্র ছোট বোন সাফা হোসেন রাইসা বলেন, আমার বড় বোন ছিল অত্যন্ত ভালো। আমাকে অনেক আদর করতো। অনেক জেদি হলেও মনটা ছিল অনেক ভালো। কারও সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারত না। রাগলেও পরক্ষণেই আবার হাসিমুখে কথা বলত। আমার বোনের কথা অনেক মনে পড়ে। তবুও আমার বোন আর আসে না। বোনকে আমি কোথায় পাব?

শহিদ নাফিসার নানা ইমান আলী বলেন, নাফিসা ছোটবেলা থেকেই ছিল অনেক জেদি আর সাহসী। যা বলতো তাই করত। কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রায়ই যেত নাফিসা। যেতে নিষেধ করলেও কারও কথা শুনতো না। গত ৪ আগস্টও নাফিসাসহ ওর অন্য বন্ধুরা মিছিল নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে আবার সাভার আসে। দুপুরে ওকে আমি ফোন দিয়ে বলি তুমি কোথায়, তখন ও বলে আমি সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে আন্দোলনে আছি। তখন আমি ওকে বাড়ী ফিরে আসতে বললে ও বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে। রাতে ও আমাকে পরদিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট রোড মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশ নিতে রাজধানী ঢাকার গাবতলী যাওয়ার কথা বললে আমি তাকে বলি তোমার যাওয়ার দরকার নেই, তুমি ওখানে কিছু চিনবে না। তখন নাফিসা আমার সাথে রাগ করে পরদিন ঢাকা যাওয়ার জেদ ধরে। সে অনুযায়ীই পরদিন ৫ আগস্ট সকাল বেলা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

শহিদ নাফিসার ছোট মামা হযরত আলী জানায়, নাফিসা আমার কাছে থেকেই পড়াশোনা করত। সম্পর্কে বোনের মেয়ে হলেও ওকে আমি মেয়ের মতোই স্নেহ করতাম। কিছুদিন হলো ও ওর বাবার কাছে গাজীপুর থেকে পড়াশোনা করছে।

মেয়ে হিসেবে নাফিসা অনেক সাহসী আর উদ্যমী ছিল উল্লেখ করে হজরত আলী আরও বলেন, পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো ছিল নাফিসা। সবার সাথেই সুসম্পর্ক ছিল তার। আমিই ওর মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসি। কোথা থেকে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। নাফিসার মৃত্যুতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।

নাফিসার নানি আমেনা বেগম জানান, নাফিসা ছিল অনেক ভালো। ও ছিল অনেক দায়িত্ববান। মা বিদেশে থাকলেও নিজেকে কীভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হয় তা ও জানতো। এজন্য সবাই আমরা ওকে অনেক আদর ও স্নেহ করতাম। ভালোবাসতাম। আমাদের নাতনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। ওর মায়া আমাদের আজও তাড়া করে ফেরে। ওর স্মৃতি কিছুতেই ভোলা যাবে না।

প্রবাসে থাকা শহীদ নাফিসার হতভাগ্য মা কুলসুম বেগম মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কুয়েত থেকে ছুটে আসেন বাংলাদেশে। বারবার হাতড়ে ফেরেন মেয়ে নাফিসার স্মৃতি বই-খাতাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। তবুও ভুলবার নয় মেয়ে হারানোর বেদনা। ছলছল চোখে মেয়ে হারানোর শোক সইবার চেষ্টা করছেন।

কুলসুম বেগম বলেন, পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে আমি প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলাম। অভাব অনটনের সংসারে পড়ালেখা শেষে আমার সাথে সংসারের হাল ধরতে চেয়েছিল নাফিসা। কীভাবে ভুলি সেইসব স্মৃতি, আজ আমাদের সেই স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেছে।


এই সম্পর্কিত আরও খবর

আরও খবর

news image

আবারও রাস্তায় ছাত্র আন্দোলনে ভাইরাল হওয়া সেই রিকশাচালক

news image

বাংলাদেশিকে ধরতে এসে পা ধরে মাফ চাইলো বিএসএফ

news image

অবৈধ সম্পদ: সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের নামে মামলা

news image

শেখ রেহানার স্বামী-দেবরসহ ৮ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

news image

নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব পুলিশের ও আমাদের

news image

ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারে সরকার বদ্ধপরিকর : আইন উপদেষ্টা

news image

জাতীয় সনদ তৈরিতে সবার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে : আলী রীয়াজ

news image

এপ্রিলেই দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া, সঙ্গে থাকবেন দুই পুত্রবধূ

news image

এবার গরমে লোডশেডিং সীমিত পর্যায়ে রাখতে চাই : জ্বালানি উপদেষ্টা

news image

‘দেশের জন্য ভাবতে হবে জুলাই যোদ্ধাদের মতো’

news image

সাবেক এপিএস মোয়াজ্জেমের বিষয়ে দুদককে তদন্তের অনুরোধ উপদেষ্টা আসিফের

news image

শাহরিয়ারের ২৭ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ, লেনদেন ২৬১ কোটি

news image

বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় অস্ট্রেলিয়া

news image

বাবার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

news image

বাংলাদেশকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক

news image

অবশেষে সরানো হচ্ছে কুয়েটের উপাচার্যকে

news image

মে মাসেই দেশে স্পেসএক্স স্যাটেলাইট পরিষেবা শুরুর আশা

news image

হাসিনার আমলে আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যা মামলা হয়েছে : আইন উপদেষ্টা

news image

পৃথিবীর জন্য আশার বাতিঘর হতে চায় বাংলাদেশ : ড. ইউনূস

news image

হাসিনাসহ শেখ পরিবারের ১০ সদস্যের ‘এনআইডি লক’

news image

প্রধান উপদেষ্টা কাতার যাচ্ছেন আজ

news image

ভবেশের মৃত্যুতে ভারতের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান বাংলাদেশের

news image

‘ক্যাবিনেট মিটিংয়ে ওদের মতামতটা খুব তীক্ষ্ণ হয়’

news image

ভিডিও দেখে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঝটিকা মিছিলকারীদের, জানালো পুলিশ

news image

আগামী নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোত্তম নির্বাচন

news image

‘আমাদের মধ্যে বিশাল আঞ্চলিক বাজার রয়েছে, এটি কাজে লাগানো উচিত’

news image

অর্থনৈতিক অপরাধে জড়িতদের বিচারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে

news image

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সচিব পর্যায়ের বৈঠক শুরু

news image

‘তারেক রহমান আসছে’ স্লোগানে মুখর ঢাকার আদালতপাড়া

news image

সায়েন্সল্যাবে দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ নিয়ে যা বলছে পুলিশ