মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
জাতীয়

‘বাবা, আমি মারা যাচ্ছি, আমার লাশটা নিয়ে যেও’

নিজস্ব প্রতিবেদন ১০ নভেম্বার ২০২৪ ০৯:৩৫ পি.এম

‘বাবা, আমি মারা যাচ্ছি, আমার লাশটা নিয়ে যেও’ ছবি: সংগৃহীত

অভাব-অনটনের সংসার। তাই নাফিসা চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষে প্রবাসী মায়ের সাথে সংসারের হাল ধরতে। কিন্তু তার এ ইচ্ছে আর পূরণ হলো না। বুলেটের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল তার স্বপ্নের আকাশ।

বলছিলাম সাভারের একমাত্র নারী শহীদ ও শিক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়ারের কথা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের পাকিজার সামনে ঘাতকের একটি বুলেট নিস্তব্ধ করে দেয় রাজপথের অগ্রসৈনিক নাফিসাকে। বুলেট বুকের একপাশ ভেদ করে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে দুঃসাহসী নাফিসা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল গাজীপুরের টঙ্গীর দত্তপাড়ার সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল এন্ড কলেজের এইসএসসির পরীক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭)। পিতা চা দোকানি আবুল হোসেন এবং মা কুয়েত প্রবাসী কুলসুম বেগম। গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদনগরে। প্রথমে সাভারের মামার বাড়িতে থেকে সাভার ল্যাবরেটরি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে এইসএসসি পর্যন্ত পড়লেও পরবর্তীতে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে বাবার কাছে গাজীপুরে এসে ভর্তি হন সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল এন্ড কলেজে। মা কুলসুম বেগম ভাগ্য ফেরাতে চা দোকানী স্বামীকে রেখে কুয়েতে যাওয়ার পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। একপর্যায়ে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নাফিসা হোসেন মারওয়া ছাড়াও সাফা হোসেন রাইসা (১২) নামের আরও একটি মেয়ে রয়েছে আবুল হোসেন-কুলসুম দম্পত্তির।

নাফিসা সাহাজুদ্দিন সরকার স্কুল এন্ড কলেজ থেকেই অংশ নেন ২০২৪ সালের এইসএসসি পরীক্ষায়। ফলও বের হয়। উত্তীর্ণ হন জিপিএ ৪.২৫ পেয়ে। কিন্তু রেজাল্ট দেখার সৌভাগ্য হয়নি নাফিসার। তার আগেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদ হন তিনি। সেই সাথে ধুলিসাৎ হয়ে যায় খুঁড়িয়ে চলা একটি পরিবারের স্বপ্ন।

শহীদ নাফিসার বাবা আবুল হোসেন বলেন, আমার মেয়ে নাফিসা ছিল অত্যন্ত সাহসী। পড়াশোনায়ও ছিল ভালো। আমার সায় না থাকলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই নাফিসা ছিল সোচ্চার। প্রতিটি আন্দোলনে অন্যান্য শিক্ষার্থীর সাথে ও রাজপথে থাকতো। আমার বাসা থেকে প্রায় এক সপ্তাহ আগে গত ২৭ জুলাই নাফিসার বড় মামা হানিফ আলীর বাড়ি ঢাকার ধামরাইয়ে যায়। সেখানে তিনদিন বেড়ানো শেষে ৩০ জুলাই চলে যায় ওর ছোট মামা হযরত আলীর বাড়ি সাভারের কোটবাড়ি এলাকায়। সেখানে থেকেই আগের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে যোগ দিত আন্দোলনে।

আবুল হোসেন বলেন, ওর মায়ের সাথে কথা না হলেও আমার মেয়ে নাফিসার সাথে আমার প্রায়ই কথা হতো। ঘটনার দিন গত ৫ আগস্ট দুপুরে হঠাৎ-ই আমার মেয়ে নাফিসা আমাকে বলে, বাবা তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি টিভি দেখ, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা না কি পালাইছে, তখন আমি তাকে বলি মা আমরা গরিব মানুষ, আমি চা দোকানদার, আমাদের এসব দিয়ে কী হবে, তুমি বাড়ি চলে আসো, তখন আমার মেয়ে আমাকে বলে, ‘বাবা দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমি বাড়ি ফিরব না, আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব’। এর কিছুক্ষণ পর দুপুর আড়াইটার দিকে আবার আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘বাবা আমি গুলি খেয়েছি, আমি মনে হয় আর বাচঁব না, আমি মারা যাচ্ছি, আমি ল্যাবজোন হাসপাতালে আছি, আমার লাশটা নিয়ে যেও’। তখন আমি দোকান ফেলে দ্রুত সাভারের উদ্দেশে রওনা দেই। আসতে আসতে পথিমধ্যে আমি আমার মেয়ের মোবাইলে ফোন দেই। তখন আমার মেয়ের মোবাইলটি অন্য কেউ রিসিভ করে আমাকে বলে, আপনি কে বলছেন, তখন উত্তরে আমি নাফিসার বাবা পরিচয় দিলে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আমাকে জানানো হয় আপনার মেয়ে আর নেই, মারা গেছেন, লাশ এখন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে রয়েছে। আসার পথে সড়কের অবস্থা ভালো না থাকায় আমার আসতে খানিকটা দেরি হওয়ায় হাসপাতাল থেকে নাফিসার ছোট মামা হজরত আলী নাফিসার মৃতদেহ নিয়ে আসে। পরে আমাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদনগরে কবরস্থ করা হয় নাফিসাকে।

শহীদ নাফিসা হোসেন মারওয়ার একমাত্র ছোট বোন সাফা হোসেন রাইসা বলেন, আমার বড় বোন ছিল অত্যন্ত ভালো। আমাকে অনেক আদর করতো। অনেক জেদি হলেও মনটা ছিল অনেক ভালো। কারও সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারত না। রাগলেও পরক্ষণেই আবার হাসিমুখে কথা বলত। আমার বোনের কথা অনেক মনে পড়ে। তবুও আমার বোন আর আসে না। বোনকে আমি কোথায় পাব?

শহিদ নাফিসার নানা ইমান আলী বলেন, নাফিসা ছোটবেলা থেকেই ছিল অনেক জেদি আর সাহসী। যা বলতো তাই করত। কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রায়ই যেত নাফিসা। যেতে নিষেধ করলেও কারও কথা শুনতো না। গত ৪ আগস্টও নাফিসাসহ ওর অন্য বন্ধুরা মিছিল নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে আবার সাভার আসে। দুপুরে ওকে আমি ফোন দিয়ে বলি তুমি কোথায়, তখন ও বলে আমি সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে আন্দোলনে আছি। তখন আমি ওকে বাড়ী ফিরে আসতে বললে ও বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে। রাতে ও আমাকে পরদিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট রোড মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশ নিতে রাজধানী ঢাকার গাবতলী যাওয়ার কথা বললে আমি তাকে বলি তোমার যাওয়ার দরকার নেই, তুমি ওখানে কিছু চিনবে না। তখন নাফিসা আমার সাথে রাগ করে পরদিন ঢাকা যাওয়ার জেদ ধরে। সে অনুযায়ীই পরদিন ৫ আগস্ট সকাল বেলা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

শহিদ নাফিসার ছোট মামা হযরত আলী জানায়, নাফিসা আমার কাছে থেকেই পড়াশোনা করত। সম্পর্কে বোনের মেয়ে হলেও ওকে আমি মেয়ের মতোই স্নেহ করতাম। কিছুদিন হলো ও ওর বাবার কাছে গাজীপুর থেকে পড়াশোনা করছে।

মেয়ে হিসেবে নাফিসা অনেক সাহসী আর উদ্যমী ছিল উল্লেখ করে হজরত আলী আরও বলেন, পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো ছিল নাফিসা। সবার সাথেই সুসম্পর্ক ছিল তার। আমিই ওর মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসি। কোথা থেকে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। নাফিসার মৃত্যুতে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।

নাফিসার নানি আমেনা বেগম জানান, নাফিসা ছিল অনেক ভালো। ও ছিল অনেক দায়িত্ববান। মা বিদেশে থাকলেও নিজেকে কীভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হয় তা ও জানতো। এজন্য সবাই আমরা ওকে অনেক আদর ও স্নেহ করতাম। ভালোবাসতাম। আমাদের নাতনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। ওর মায়া আমাদের আজও তাড়া করে ফেরে। ওর স্মৃতি কিছুতেই ভোলা যাবে না।

প্রবাসে থাকা শহীদ নাফিসার হতভাগ্য মা কুলসুম বেগম মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে কুয়েত থেকে ছুটে আসেন বাংলাদেশে। বারবার হাতড়ে ফেরেন মেয়ে নাফিসার স্মৃতি বই-খাতাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। তবুও ভুলবার নয় মেয়ে হারানোর বেদনা। ছলছল চোখে মেয়ে হারানোর শোক সইবার চেষ্টা করছেন।

কুলসুম বেগম বলেন, পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে আমি প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলাম। অভাব অনটনের সংসারে পড়ালেখা শেষে আমার সাথে সংসারের হাল ধরতে চেয়েছিল নাফিসা। কীভাবে ভুলি সেইসব স্মৃতি, আজ আমাদের সেই স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেছে।


এই সম্পর্কিত আরও খবর

আরও খবর

news image

ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠকে রাজনীতিতে স্বস্তির পরিবেশ ফিরেছে

news image

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় ঝড়ের আভাস

news image

দশ দিনের ছুটি শেষে আজ খুলছে সরকারি অফিস

news image

বিএনপিও ছাড় দিয়েছে, কিন্তু কেন?

news image

দিল্লিতে গোপন সাক্ষাৎকারে জয়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন শেখ হাসিনা

news image

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যের সম্পত্তি জব্দ

news image

পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে বাংলাদেশকে সমর্থন যুক্তরাজ্যের

news image

ঘেউ ঘেউ করার জন্য মাত্র ২০টা লোক পাইলো: শফিকুল আলমের স্ট্যাটাস

news image

এনসিপির ক্রাউডফান্ডিংয়ে প্রায় ১৪ লাখ টাকা অনুদান সংগ্রহ

news image

চাঁদের মাটিতে পা রাখতে যাচ্ছেন প্রথম বাংলাদেশি নারী

news image

টিউলিপের চিঠি পেয়েছি : প্রেস সচিব

news image

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এয়ারবাসের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ

news image

বিএনপির হাতে ১২৩ খুন, মির্জা ফখরুলের ভিন্নমত পোষণ

news image

টিউলিপের সাক্ষাতের আবেদন নাকচ ড. ইউনূসের

news image

ভারতে নিহত সাবেক এমপি আনারের কোটি টাকার গাড়ি মিলল কুষ্টিয়ায়

news image

খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপে প্রধান উপদেষ্টার বিষয়ে বিএনপির অবস্থান বদল

news image

আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট না থাকায় গ্রেপ্তার করা হয়নি: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

news image

আজ থেকে যমুনা ও সচিবালয়ের আশপাশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ

news image

ড. ইউনূসের সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ কামনায় মোদি

news image

ভারত কখনোই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখতে চায় না: রিজভী

news image

ঈদের ফিরতি যাত্রায় সবাইকে মাস্ক পরার অনুরোধ

news image

সৌদির ওয়ার্ক ও ওমরাহ ভিসা সাময়িকভাবে স্থগিত

news image

বাংলাদেশে যেভাবে গরু কোরবানি মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হলো

news image

ঢাকা উত্তরের ৮৫ শতাংশ বর্জ্য অপসারণ শেষ

news image

৩৫ হাজার মানুষের পরিশ্রমে পরিচ্ছন্ন সব সিটি কর্পোরেশন: আসিফ মাহমুদ

news image

ড. ইউনূসের অপেক্ষায় ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস

news image

ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সরকার সচেষ্ট রয়েছে: উপদেষ্টা আসিফ

news image

দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন তারেক রহমান

news image

আ.লীগ নেতারা আত্মগোপনে থাকায় বড় গরুর বিক্রি কম

news image

ড. ইউনূসের লন্ডন সফরে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে যা জানা যাচ্ছে