শনিবার ১৭ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
জাতীয়

বিডিআর বিদ্রোহের বিচার পুনরায় করা সম্ভব?

নিজস্ব প্রতিবেদন ১৩ সেপ্টেম্বার ২০২৪ ১০:৫৮ এ.এম

বিডিআর বিদ্রোহের বিচার পুনরায় করা সম্ভব? ছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারো ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আলোচনা সামনে এসেছে। নতুনভাবে সামনে আসছে নানা অভিযোগ আর ষড়যন্ত্রের আলোচনা। এই ঘটনায় রাজনৈতিক দোষারোপ আগেও হয়েছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া অতীতে একাধিকবার এর পেছনে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছেন।
একইভাবে শেখ হাসিনাও বারবার আঙুল তুলেছিলেন বিএনপি ও জামায়াতের দিকে।
পিলখানা ঘটনার ১৫ বছর পেরিয়ে যাবার পর এখন পুনরায় তদন্তের দাবি আসছে বিভিন্ন তরফ থেকে। সে ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সেনা ও বিডিআর পরিবার তো বটেই, তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদও ভিডিও বার্তায় সেই দাবি তুলেছেন। সেনাবাহিনীর তদন্ত আদালতে সরকারের সহযোগিতা না করার অভিযোগও করেছেন মঈন ইউ আহমেদ।
যদিও তার বিরুদ্ধেও এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ করে এসেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল।


সেনাবাহিনী ও তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের পরিবারগুলোর অনেকে ঘটনাটিকে‘বিডিআর বিদ্রোহ’বলতে চান না। তাদের মতে পুরো বিষয়টিই ছিল ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি আসছে আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারতের নাম।


বিডিআর নায়েক শামছুল ইসলামের ছেলে জুয়েল আজিজ বলেন, ‘পিলখানার গণ্ডগোলটা যদি না হতো তাহলে এই সরকার এতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারত না। কারণ পিলখানার ঘটনা দিয়েই সেনাবাহিনীকে দমন করে সরকার এতদিন ক্ষমতায় ছিল।’ বিডিআর পরিবারের আরেক সদস্য আইনজীবী আব্দুল আজিজ ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে বলছিলেন, ‘বড়াইবাড়ি যুদ্ধে আমার আব্বু বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রধান সহকারী ছিল বলে তাকে টার্গেট করা হয়।’

২০০১ সালে কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়ি গ্রামে (রৌমারী সীমান্তে) ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সাথে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনীর রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয়, যেখানে ১৬ জন বিএসএফ ও ২ জন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সেনা নিহত হন। আব্দুল আজিজের বাবা আব্দুর রহিম তৎকালীন বিডিআরের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে জানান আব্দুল আজিজ।

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয় এবং কারা হেফাজতে তার মৃত্যু হয় ২০১০ সালে। ওই ঘটনায় আগের অপমৃত্যুর মামলা থাকলেও এখন নতুন করে সিএমএম আদালতে একটি মামলা করেছেন আব্দুল আজিজ।
সেখানে অভিযুক্ত তালিকায় এসেছে শেখ হাসিনা, জেনারেল আজিজ আহমেদ, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, হাসানুল হক ইনুসহ বেশ কয়েকজনের নাম। এছাড়াও তৎকালীন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মহাপরিদর্শক, জেল সুপার, দায়িত্বরত ডাক্তারসহ ২০০ জন অজ্ঞাতনামাকে আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

আব্দুল আজিজ জানান, তার বাবার বিরুদ্ধে পোক্ত প্রমাণ না থাকায় তাকে রাজসাক্ষী করার চেষ্টা করা হয়। তিনি বলেন, ‘উনি রাজসাক্ষী হন নাই। ১৭ মাস তিনি কারাভোগ করার পরে পরবর্তীতে উনি অসুস্থ হন। পায়ে এবং পেটে ব্যথা ছিল। আম্মু দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন কী চিকিৎসা দেয়া হয়েছে, আব্বু বলেন যে আমাকে ইনজেকশন দেয়া হইসে। এই ইনজেকশন দেয়ার ১৮-২৪ ঘণ্টার ভেতর আমার আব্বু মারা যান।’

আব্দুল আজিজ আরো বলেন, ‘আমার বোন ও ভাইকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে বিদ্রোহীর সন্তান বলে, আমাদের লেখাপড়া থেকে প্রতিটা পদে পদে বঞ্চনা করা হয়েছে।’

বিডিআর নায়েক শামছুল ইসলামের সন্তান জুয়েল আজিজও জানান ক্ষোভের কথা। তিনি বলেন, নিজের চোখেই দেখলাম যে গোলাগুলি চলতেছে, সবাই এদিক ওদিক ছুটতেসে। অথচ আমার বাবা তার অফিসরুমে নামাজে দাঁড়ায় গেছেন। আমার সেই নামাজরত বাবার তিন বছরের সাজা হইসে। টোটাল সাত বছর জেল খেটে বের হইসে। এরপর যতদিন তার বাবা বেঁচে ছিলেন ততদিন সবসময় খুব বিমর্ষ থাকতেন এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ মাথায় নিয়েই তার মৃত্যু হয়।

জুয়েল আজিজ জানান, তার বাবা বেঁচে থাকতে ‘দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত সারাজীবন সততার সাথে চাকরি করে শেষ বয়সে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা মাথায় নিয়ে মারা যাওয়া যে কতটা কষ্টের বাবা তোরা বুঝবি না। সন্তান হিসেবে চাই আমার বাবা মরণোত্তর কলঙ্কমুক্ত হোক।’

আব্দুল আজিজ এবং জুয়েল আজিজ ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ঐক্য’ নামের সংগঠনের যথাক্রমে আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব। নয় দফা দাবি নিয়ে তারা আজ শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানবন্ধনের ডাক দিয়েছেন। পিলখানায় নিহত সেনাসদস্যদের পরিবারের তরফ থেকেও বেশ কিছু দাবি সামনে আনা হয়েছে। এর মাঝে আগের সব তদন্ত প্রতিবেদন বিস্তারিত প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্ত বা চাকরীচ্যুত পরিবারের ক্ষতিপূরণ, নির্দোষ বিডিআর সদস্যদের মুক্তির মতো বিষয়ও রয়েছে।

এর পাশাপাশি আগেকার তদন্তে যেসব নাম উঠে আসেনি সেগুলো সামনে আনা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন সাকিব রহমান, যিনি প্রয়াত কর্নেল কুদরত ইলাহী রহমান শফিকের সন্তান ও আইনজীবী। কুদরত ইলাহী রহমান বলেন, ‘আগেকার মামলায় যাদের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে তারা ‘হয়তো সেই অ্যাকশনের সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু এটার মাস্টারমাইন্ড যারা কিনা পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে, তাদেরকে বের করাটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।’

বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অবশ্য পুনরায় তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। যিনি তৎকালীন সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির দায়িত্বে ছিলেন। সঠিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া শিগগিরিই শুরু করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তিনি।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। ১৫ জনের মৃত্যু হওয়ায় উচ্চ আদালতে মোট ৮৩৫ আসামির শুনানি শুরু হয়। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় ২২৮ জনের। খালাস দেয়া হয় ২৮৩ জনকে। পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ হয়েছিল ২০২০ সালে। এখনো আপিল বিভাগে ঝুলছে অনেকের আবেদন। ঝুলছে বিস্ফোরক মামলাও। তবে ১৫ বছর পর এসে নতুন করে তদন্ত বা বিচারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের জায়গা রয়েছে।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ‘এটার মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন আলামত, সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স, এবং ঐ সময়কার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সাক্ষ্যপ্রমাণের বিষয়গুলো হয়তো অনেক সময় এভেইলেবল থাকবে না।’

তবে আগের যেসব তথ্যপ্রমাণ রয়েছে সেগুলোর সাথে আগে হয়তো সাক্ষ্য দিতে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে, বা আগে দিতে পারেননি এমন হলে এখনো তদন্ত সম্ভব বলে জানান তিনি। শিহাব উদ্দিন বলেন, যদি বিষয়টি এমন হয় যে পুনঃতদন্ত চাওয়া হচ্ছে এইজন্য যে যাদের সংযোগে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে বা কী কারণে সংগঠিত হয়েছে, মোটিফ কী ছিল, এই জায়গাগুলো বের হয়ে আসেনি সেটি আমার মনে হয় এই পর্যায়েও সফলভাবে করা সম্ভব।

আগের বিচারপ্রক্রিয়ায় যে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করার অভিযোগ এসেছে, পুনরায় তদন্তের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনার যেন না আসে এবং আসলেই যারা পরিকল্পনার সাথে জড়িত সেটা সঠিকভাবে সামনে আনার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

পিলখানার ঘটনাটির পরিসর বেশ বড়। পূর্ণাঙ্গ বিচারও প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। ১৫ বছরে অনেকের সাজা ভোগ শেষ হয়েছে, অনেকে অপেক্ষায়, আবার অনেকে মারাও গেছেন। তবে এ নিয়ে অনেক ধরনের আক্ষেপের জায়গাও রয়ে গেছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে এখন নতুন মাত্রা যুক্ত হবে কিনা সেদিকে নজর থাকবে সামনের দিনগুলোতে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা


এই সম্পর্কিত আরও খবর

আরও খবর

news image

বাংলাদেশ থেকে বেশি লোক নেবে মালয়েশিয়া: আসিফ নজরুল

news image

আবদুল হামিদের বিদেশে অবস্থান নিয়ে ছেলের ফেসবুকে স্ট্যাটাস

news image

সাবধান, ছাত্রদের গায়ে যাতে একটা টোকাও না লাগে: উমামা ফাতেমা

news image

‘৯ বিয়ে করা’ তালহার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ হ্যাপির

news image

জনদাবির মুখে ছাত্র উপদেষ্টাদের ঠেলে দেওয়ার আচরণ সন্দেহজনক: হাসনাত

news image

মাহফুজ ভাইয়ের সঙ্গে যা ঘটল, তাতে হতাশ হয়েছি : উপদেষ্টা আসিফ

news image

ফেসবুক-ইউটিউবসহ আ. লীগের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম বন্ধে বিটিআরসিকে চিঠি

news image

পুলিশের বাধার পর বৃষ্টি, কাকরাইল ছাড়েননি জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা

news image

দেশের অর্থনীতি পাল্টাতে চট্টগ্রাম বন্দরই আমাদের ভরসা : প্রধান উপদেষ্টা

news image

কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, নেই প্রধান উপদেষ্টার নাম

news image

সম্পদের তথ্য গোপন মামলায় জোবাইদা রহমানের জামিন

news image

চট্টগ্রাম পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা, যা থাকছে কর্মসূচিতে

news image

শেখ হাসিনার বিষয়ে নাক গলাতে চান না রাহুল গান্ধী

news image

‘জুলাইয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে জেনোসাইড হয়নি, বিভ্রান্তি ছড়াবেন না’

news image

দুর্নীতির মামলায় ৩ বছরের সাজার বিরুদ্ধে ডা. জোবাইদার আপিল

news image

থাইল্যান্ডে ক্যানসার পরীক্ষা করবেন আবদুল হামিদ

news image

আ.লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো, লড়াই এখনও বাকি : মাহফুজ আলম

news image

ড. ইউনূসের নিজস্ব কোনো সম্পত্তি নেই: প্রেস সচিব

news image

ফ্যাসিস্টদের পালিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের প্রাথমিক বিজয় : আলী রীয়াজ

news image

জুলাইকে মেনে না নিয়ে শান্তিতে থাকার সুযোগ নেই: উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

news image

নিষিদ্ধের বিধান যুক্ত করে সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশ অনুমোদন

news image

‘বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে’

news image

সারা দেশে বিশৃঙ্খলার পরিকল্পনা হচ্ছে : আসিফ মাহমুদ

news image

ভারতে ৬ টিভির ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ: ব্যাখ্যা না পেলে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে সরকার

news image

যুমনার সামনে বিক্ষোভ, রাত পেরিয়ে সকাল থামছে না স্লোগান

news image

যেভাবে দেশ ছাড়লেন আবদুল হামিদ

news image

‘ইন্টেরিম’ এখন পর্যন্ত কী কী বিচার ও সংস্কার করেছেন? প্রশ্ন হাসনাতের

news image

শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মিজান গ্রেপ্তার

news image

রাজনীতিতে ফিরছেন না খালেদা জিয়া

news image

কোচিং বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষা উপদেষ্টার সহায়তা চায় অভিভাবক ফোরাম